ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার শত বছরের পুরনো বিনিময় প্রথার শুঁটকি মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার ও বুধবার দুই দিনব্যাপী উপজেলার কুলিকুন্ডা গ্রামের কুলিকুন্ডা (উওর) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে 'পন্যের বিনিময়ে শুটকি অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলায় শত বছর ধরে বিনিময় প্রথার এই শুটকি মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছেছে। মেলায় পণ্যের মধ্যে প্রধান পণ্য হলো শুঁটকি।
গ্রামের লোকজন জানান, প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের দ্বিতীয় দিন থেকে বাংলা পঞ্জিকার নিয়মানুযায়ী নববর্ষের দ্বিতীয় দিনে হিন্দুদের পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। স্থানীয় জেলেরা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই ব্যতিক্রমধর্মী এ মেলা করে থাকে। তবে এবার নববর্ষের প্রথমদিন মঙ্গলবার ভোর সকাল থেকে এই মেলা শুরু হয়।
গ্রামবাসী ও মেলায় আসা একাধিক ব্যক্তি জানান, কবে মেলার প্রথম আয়োজন তা জানা না গেলেও প্রতিবছরই এই মেলা বসে। এই ‘শুঁটকি মেলা’ প্রায় চার শ বছরের পুরোনো। কেউ কেউ বলেন, দুই শ বছরের পুরোনো। আবার কারও কারও ধারণা, তিনশ বা পাঁচশ বছরের পুরোনো এই মেলা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শুঁটকি ব্যবসায়ী ছাড়াও ভোজনরসিকেরা আসেন এ মেলায়।
জানা গেছে, প্রাচীনকালে যখন কাগজের মুদ্রা প্রচলন হয়নি, ঠিক তখন স্থানীয় হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোকজন নিজেদের উৎপাদিত শুঁটকি বিক্রি করতেন। স্থানীয় কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত চাল, ডাল, ধান, শিমের বিচি, আলু, সরিষা, পেঁয়াজ ও রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কিনতেন। এই মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কেনাবেচা। মেলায় প্রাচীন আমলের পণ্য বিনিময়ের প্রথা ঐতিহ্য রক্ষায় স্বল্প সময়ের জন্য হলেও পণ্যের বিনিময়ে শুটকির বিনিয়ময় হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই ঐতিহ্য বন্ধ রয়েছে । এখন নগদে বিক্রি হয়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শুঁটকি ব্যবসায়ীরাও শুঁটকি বিক্রি করতে এবং কিনতে মেলায় এসেছেন। মেলায় শুঁটকির পাশাপাশি গৃহস্থালি সামগ্রীসহ শিশুদের নানা ধরনের খেলনাও বিক্রি হয়।
কথা বলে জানা গেছে, শুধু স্থানীয় লোকজন নয়, সিলেট, হবিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, সুনামগঞ্জ, ভৈরবসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা মেলায় আসেন। শুঁটকি ছাড়াও ইলিশ ও কার্পজাতীয় বিভিন্ন মাছের ডিমও রয়েছে দোকানিদের পসরায়। ২৩ বছর ধরে মেলায় শুঁটকি বিক্রি করে আসছেন সরাইল উপজেলার আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, বোয়াল, বাইম, ছুরি, আইল, বামট মাছ ও রিডাসহ ১২জাতের মাছের শুঁটকি এনেছেন। এবছর ৯-১০লাখ টাকার শুটকি এনেছি। একই উপজেলার ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের অমর দাস বলেন, ২০-২৫ জাতের শুঁটকি এনেছি, যার মূল্য ৬-৭ লাখ টাকা। পাঁচ বছর ধরে এই শুটকি মেলায় আসছি। গত বছর করোনার কারণে এক ঘন্টা অবস্থান করে ৩০ হাজার টাকা শুটকি বিক্রি করতে পেরেছিলাম।
তবে মেলায় প্রথমবার এসেছেন আশুগঞ্জ লালপুরের সাধন দাস। তিনি বলেন, ২০জাতের শুঁটকি এনেছি। যাদের বাজার মূল্য আড়াই লাখ টাকা। শুঁটকি মেলায় বেচাকেনা ভালো হয় বলে লোকমুখে শুনেছি। তাই আশা নিয়ে এসেছি।
৩৫বছর ধরে শুঁটকি মেলায় বেচাকেনা করেন হরাধন দাস। তিনি বলেন, এবার ৪লাখ টাকার শুঁটকি নিয়ে মেলায় এসেছেন। গত বছর সাড়ে চার লাখ টাকার শুঁটকি বিক্রি করেছি।স্থানীয় শামসু মিয়া (৬৮), আবু মিয়া (৫২), আলতাফ হোসেন ও চাকুরীজীবি মোতাহার হোসেন বলেন, মুঘল শাসন আমল থেকে এখানে বিনিময় প্রথার শুঁটকি মেলা বসেছে। বাপ দাদারা তাই বলেছে। এই মেলা ইজারা ও ডাকমুক্ত
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন